বিবর্ণ গোধূলি –
-কি আমার আনিসের বিয়ে ?
চমকে উঠলেন নাদিয়া সরকার। এত বড় গর্হিত কাজ করতেই পারেনা ওঁর ছেলেরা।
–হ্যাঁ বুজান সত্যি কথা এডা।
-তুই কিভাবে জানলি ?
-খলিল ভাই গ্যাছল আপনাগেরে শহরের বাড়িত। ওঁই শুন্যা অ্যাসছে। দ্যাখেও অ্যাসছে কি সুন্দর কর্যা বাড়িডা সাজাছে।
অবসন্নভাবে বিছানায় বসে পড়েন নাদিয়া। তবে যে ওরা এখানে ওঁকে রেখে যাবার সময় বলে গিয়েছিল,
–কিছুদিন থাক এখানে। তোমার ছেলেবেলার কত স্মৃতি আছে। ভাল লাগবে তোমার, ভাল থাকবে তুমি।
-তোমরা আবার কবে আসবে বাবা ?
জানতে চেয়েছিলেন।
-এই তো চলে আসব। তুমি ভেবো না একদম। আর মোবাইল ফোন তো থাকলই , খারাপ লাগলে ফোন কোরো।
প্রথম প্রথম ছেলেদের কথা বিশ্বাস হত উনাদের। কিন্তু ওটা কেমন যেন ফিকে হয়ে আসছে। ভরসা পাচ্ছেন না আর ওদের উপর। আর ফোন ! প্রথম প্রথম ছেলেরাই করত। উনি অভিমান করে ফোনে হাতও দিতেন না, ফোন করা তো দূরের কথা। এখন উনি নিজে থেকে করেন। কিন্তু কেউ সে ফোন রিসিভ করে না।
দুপুরে খেতে বসে ছেলেদের কথাই ভাবছিলেন নাদিয়া। কিন্তু আজও দুই/ এক লোকমা মুখে দিয়ে উঠে পড়তে হল উনাকে।
-ভাত থুয়া উঠা পড়লেন ক্যা ?
আসিয়া ছুটে এলে ওকে বললেন,
-আজকেও অনেক ঝাল দিয়েছিস তরকারীতে ! এত ঝাল আমি খেতে পারিনা। কতবার বলেছি যে এত ঝলা দিবিনা তরকারীতে।
-আজক্যা ঝাল কত কমায়ে দিনু..
-যা তো নিয়ে যা সামনে থেকে।
হঠাৎ রেগে ওঠেন নাদিয়া।
আসিয়া ভয়ে সামনে থেকে চলে যায়। কিন্তু ভাতের গামলা এবং তরকারীর বাটি সঙ্গে নিতে ভুলে যায়না। সাথে গোপন একটা ধূর্ত হাসি রেখে যায় ও। নাদিয়ার চোখ এড়িয়ে যায়না ওর হাসিটা। এই খাবারগুলো দিয়ে ওর আর ওর বাচ্চাদের খোরাকী হয়ে যায়। আগে এক বেলা নিত। এখন তিনবেলাই এখান থেকে নিয়ে যায়। আর এজন্যই তরকারীতে ঝাল বেশী দেয়, যেন নাদিয়ার খেতে কষ্ট হয়। ওর দ্রুতপায়ে চলে যাওয়া দেখে একটা নিশ্বাস পড়ে নাদিয়ার। এই গ্রামে ওঁদের পাড়ার মেয়ে আসিয়া।
গরীব বলে ওঁর ছোটবেলাতেও দেখেছেন ওঁদের বাড়ীতে কাজ করত মেয়েটা। এখন তিন বাচ্চার মা হয়েছে। বিয়ে হয়েছিল এই গ্রামেই, ওঁদের পাড়াতেই। কিন্তু স্বামী ওকে ছেড়ে যেয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। অবশ্য থাকার ভিটেটুকু ওকে অলিখিতভাবে থাকতে দিয়েছে, তাড়িয়ে দেয়নি। ওখানেই তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আসিয়া থাকে। আজকাল নাদিয়া বোঝেন উনি যাতে খেতে না পারেন সেজন্য বেশী ঝাল দেয় তরকারীতে। তাতে করে বাড়ীতে যেয়ে আবার রান্না করতে হয়না।
ওঁর উচ্ছিষ্ট খাবার দিয়েই খাওয়া হয়ে যায় ওদের। যেতে যেতে স্বগতোক্তি করার মত করে বলে যায়,
–হামাগোরে ঝাল খ্যায়া অভ্যাস হছে তো , তাই..
বাকি বাক্যটুকু আর শেষ করতে দেন না নাদিয়া।
-থাক। কৈফিয়ত দিতে হবেনা।
সেই পরিচিত বাড়ীটা আজ এত অপরিচিত লাগছে কেন ! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নাদিয়া নিজের অতি যত্নে গড়া বাড়ীটার দিকে। ছেলে দুজনকে যেমন যত্ন করে মানুষ করেছিলেন ; তেমনি বাড়ীটাও যত্ন করে বানিয়েছিলেন নিজে দুই ছেলে নিয়ে থাকবেন বলে। কিন্তু..।
একটা নিঃশ্বাস বেরোল নিজের অজান্তেই। সুন্দর আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ীটাতে। আজকাল আলোকসজ্জার ধারণা পাল্টেছে মানুষের। আগের মত শুধু লাল-নীল মরিচবাতি দিয়ে সজ্জা করেনা । এখন লাল-নীলের সাথে সাদা আর সবুজ রঙও যোগ হয়েছে। খলিলকে ডেকেছিলেন গতকাল ঘটনা সত্যি কিনা জনার জন্য।
-সত্যি বুজান।
ইতস্তত করে বলেছিল ও।
-সত্যি ! তুই ভুল শুনে আসিস নি তো !!
মাথা নিচু করে খলিল। সে’ও নাদিয়াদের পুরনো চাকর। কিছুটা বিবেক অবশিষ্ট আছে হয়তো ছেলেটার এখনো । তাই মাথা নিচু করেছে। ওকে সাথে নিয়েই আজ এখানে এসেছেন নাদিয়া। একজনের হাতে লাল রঙের একটা শক্ত খাম দেখতে পেয়ে বললেন,
-বাবা, যদি কিছু মনে না কর , আমি কি তোমার হাতের কার্ডটা দেখতে পারি !
-জী , অবশ্যই পারেন। কিছু মনে করব কেন !
সুন্দর একটা সোনালী রঙের ফিতে দিয়ে খামটা বাঁধা ছিল। খুললেন খুব ধীরে ধীরে , অপ্রিয় সত্যিটা যত দেরীতে বেরোয় ততই মঙ্গল।
-কেমুন দ্যাখলেন বুজান আপনের ছাওয়ালের বিয়ার ..
এটুকু শোনার পরেই বলে উঠলেন আসিয়াকে,
-আজো কি বেশী ঝাল দিয়েছিল তরকারীতে ?
-খ্যায়া দ্যাখেন তো !
-রঙ দেখে তো মনে হচ্ছে তাই করেছিস।
তরকারীর বাটির ঢাকনাটা খুলে দেখে বললেন,
-যা নিয়ে যা, আমি খাবনা।
নিজের ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়লেন। ভাবলেন ‘সত্যি আনিস বিয়ে করছে। অথচ আমি এর বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানিনা। এরপর হয়তো আবিরও বিয়ে করবে; আমি জানব আসিয়ার মুখ থেকে’। চোখের কোণ দুটো ভিজে উঠল, উঠে চশমার কাঁচে পড়তে সে দুটো ঘোলা হয়ে যেতে চোখ মুছলেন নাদিয়া। উঠে বসলেন। ওরা যদি ওঁকে না জানিয়ে বিয়ে করার মত একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তাতে ওঁর দুঃখ পাওয়ার তো কিছু নেই।
কারণ ওদের এই মানসিক অবস্থান তৈরি হওয়ার জন্য তো উনিই দায়ী। সারাজীবন শুধু শিখিয়েছেন পড়তে আর ক্লাসে প্রথম হতে। ওদের মনে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ,’ তোমাদের পড়তে হবে, বড় হতে হবে, অনেক উঁচুতে উঠতে হবে’। কিন্তু কখনো লোক-লৌকিকতা শেখাননি। বাসায় মেহমান এলে ওদের আলাদা ঘরে বন্দী করে রাখতেন পড়ার ক্ষতি হবে বলে। তারপর শিখিয়েছেন মেয়েদের সাথে না মিশতে। ওরা ভার্সিটি জীবনে প্রবেশ করলে উপদেশ দিতেন ,
-বাবা, কোন মেয়ের ফাঁদে পা দিবেনা কিন্তু। তাহলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
সারাজীবন ওরা শুধু ওঁর কাছে ‘ না’ শব্দটাই শুনে অভ্যস্ত হয়েছে। অথচ উনি যা শেখাতেন তার বাইরে যে একটা পৃথিবী আছে তার সন্ধান বা সেটার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন। তাই আজ প্রকৃতিই অভিশাপ নিচ্ছে ওদের হয়ে।
কিছুদিন পর খবর পেলেন আবিরের বিয়েও হয়ে গেল। আনিস বিদেশে পড়তে যেয়ে এক বিদেশিনীর প্রেমে মগ্ন হয়ে তাকেই বিয়ে করেছে। আবির বিয়ে করল আপন চাচাতো বোন নিপাকে। মনে পড়ল নাদিয়ার যে একদিন কিভাবে ঐ বাড়ীটা থেকে প্রায় এক কাপড়ে শুধু ছেলে দুটোকে সম্বল করে বেরিয়ে এসেছিলেন , সেই বাড়িতেই ছেলে আবার প্রবেশ করল ওদের মেয়ের জামাই হয়ে ! নিয়তির কি অভিশাপ !! অথচ কত অহংকার ছিল ওঁর ; বাবা ছাড়া একা দুটো বাচ্চাকে মানুষ করেছেন।
সেই অহংকার মুহূর্তের ঝড়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। কিছুই করতে পারলেন না তিনি। পারবেন কি করে ! ছেলেরা তো আর উনার ফোনই ধরে না। এরপর ধীরে ধীরে উনার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল, শুকিয়ে যেতে লাগলেন। আসিয়ার প্রচণ্ড ঝাল দেওয়া তরকারী খেতে পারেন না। না খেয়ে থাকতে থাকতে এই পরিণতি হল উনার । একদিন খাদ্যনালীতে ক্ষত ধরা পড়ল । গ্রামের ডাক্তার শহরে যেয়ে পরীক্ষা করাতে বললেন। শহর ! শহর মানে তো উনার যত্নে গড়া সেই বাড়িটা ; যে বাড়িটা থেকে দুই ছেলের বিয়ে দেবেন বলে কত শখ ছিল উনার !! নাহ , ওখানে উনি যাবেন না। কাছের উপজেলা সদর হাসপাতালে যেয়ে দেখিয়ে এলেন। ডাক্তার খাদ্যনালীর ভেতর পরীক্ষা করে দেখে বলে দিয়েছেন ঝাল কম খেতে। কিন্তু এ কথা শোনাবেন কাকে !
আসিয়া আগের মতই তরকারীতে ঝাল দিতে থাকল। উনি কিছু বলেন না। ছেলেদেরকেও জানাননি কিছু, পাছে তাদের সুখে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে যায় , এই ভয়ে। মাঝে মাঝে গোরস্থানে যেয়ে বাবার কবরটা দেখে আসেন। এভাবে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে কিংবা ঝাল তরকারী খেতে খেতে একদিন খাদ্যনালীর অসুখে আক্রান্ত হবে, যাকে বলে ক্যান্সার। আর তাতে মৃত্যু হলে তো এখানেই শেষ ঘুম ঘুমোতে হবে, বাবার পাশে অতি যত্নে কেউ শুইয়ে দিবে উনাকে। উনি শুয়ে থাকবেন, কিন্তু বাবার সেই স্নেহ-স্পর্শ থেকে শুধু বঞ্চিত হবেন।